রবিবার ১৯ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লোকসানে ধুঁকতে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের নাস্তার প্যাকেটে টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪   |   প্রিন্ট   |   25 বার পঠিত

লোকসানে ধুঁকতে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের নাস্তার প্যাকেটে টাকা

ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে লোকসানে পড়া ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) নতুন পর্ষদের কর্মকান্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। গত সোমবার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের সামনে নতুন পর্ষদ সদস্যদের হাজির করলেও সদস্যরা কে কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন তা জানাতে পারেন নি।

এমনকি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের নাস্তার প্যাকেটে পাঁচ হাজার টাকার একটা খামও দেয়া হয়। সাংবাদিকরা তাতে বিব্রতবোধ করেন। প্রশ্ন উঠেছে, সংবাদ সম্মেলনে একটি ব্যাংক কিভাবে এই টাকা দিল? এই টাকাকে অপ্রদর্শিত টাকা উল্লেখ করে অনেকেই বলছেন, এটা মানি লন্ডারিংয়ের সামিল। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ব্যাংকটি এভাবেই অপ্রদর্শিত টাকা সরকারের বিরুদ্ধে অথবা জঙ্গি কার্যক্রমে কাজে লাগাতে পারে। এটার তদন্ত হওয়া উচিত। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হকের সাথে গতরাতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা রুহিন হোসেনকে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি।

গত সোমবার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ন্যাশনাল ব্যাংক আপনাদের ব্যাংক।’ সাংবাদিকরা সবাই যেন এই ব্যাংক নিয়ে ইতিবাচক লেখেন এমন আশাও করেন তিনি। সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন ছেড়ে চলে যান খলিলুর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে তার মিটিং আছে বলে জানান।

সংবাদ সম্মেলন শেষে ব্যাংক কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের হাতে নাস্তার প্যাকেট তুলে দেন। প্যাকেটটি নেওয়ার পর দেখা যায়, তার ভেতরে ‘পাঁচ হাজার টাকা’ লেখা খাম। এটি দেখার পর কয়েকজন সাংবাদিক প্যাকেট না নিয়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যান। একজন সাংবাদিক বলেন, সংবাদ প্রচারের জন্য সাংবাদিকদের টাকা দেওয়া একটি ব্যাংকের জন্য খুবই বিব্রতকর। এই টাকা তারা কোত্থেকে দিল? এটার হিসাব কী ব্যাংকে আছে?

এনবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌহিদুল আলম খান সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য করবেন না বলে জানান। এই ঘটনার পরদিন ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষের মনে ন্যাশনাল ব্যাংক সম্পর্কে নানান সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে।

যেভাবে ডুবলো ন্যাশনাল ব্যাংক
২০২২ সালে তিন হাজার ২৮৫ কোটি টাকা লোকসানের পর ২০২৩ সালে এক হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ে এনবিএল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এনবিএলের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ২৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।

বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। ১৯৮৩ সালে ব্যাংকটির পথচলা শুরু হয়। এমন এক সময়ে ব্যাংকটির যাত্রা শুরু হয়েছিল যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি সংকটে ছিল। সেই সময়ে দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে বেসরকারি খাতকে ব্যাংকিং খাতে আসতে উৎসাহিত করেছিল সরকার।
পরবর্তীতে ন্যাশনাল ব্যাংক দেশের অন্যতম ব্যাংক হয়ে ওঠে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, কারণ তখন পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংক লাভে ছিল এবং এর তারল্য পরিস্থিতি ও ঋণ আদায়ের পারফরম্যান্স ভালো ছিল। তবে ২০০৯ সালের পর সিকদার গ্রুপ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। সে বছর ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা উল্লেখযোগ্য খারাপ হয়। ব্যাংকের বার্ষিক আয় বিবরণীতে দেখা গেছে, নিট সুদ আয় ক্রমাগত কমেছে।

২০২২ ও ২০২৩, এই দুই বছরে ব্যাংকটির ৪ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এর মূল কারণ হিসেবে উচ্চ শ্রেণিকৃত ঋণকে বিবেচনা করা হয়। একই সময়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। ২০২২ সাল শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের মোট ঋণের ২৫ শতাংশ ছিল খেলাপি। এছাড়া ২০২২ সালে ব্যাংকটির শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের মোট ঋণ ও অগ্রিমের ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

এছাড়া দুর্বল আর্থিক পারফরম্যান্সের পাশাপাশি ব্যাংকটি নানা অনিয়মে জর্জরিত। ২০০৯ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সিকদার পরিবারের বিরুদ্ধে নিয়ম-নীতি না মেনে ঋণ অনুমোদনসহ নানা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৭১ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে রন হক সিকদার ও তার ভাই রিক সিকদারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলা করেছে।

গত বছর ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ব্যাংকটিকে স্থিতিশীল করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার এবং তাদের মা মনোয়ারা সিকদারকে ব্যাংকের বোর্ড থেকে সরে যেতে হয়।
এরপর গত ৬ মে পারভীন হক সিকদারের পরিচালনায় ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া নিয়ে এই পর্ষদ বিভক্ত হওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত এসেছে। এ ঘটনায় ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালক পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক পারভীন হক সিকদারের পরিচালনায় থাকা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ায় স্পষ্টতই ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের ওপর সিকদার পরিবারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।

তবে পর্ষদ ভেঙে দিলেও ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা ন্যাশনাল ব্যাংকের আগের তিনজন পরিচালককে নতুন পর্ষদে রেখেছে এবং স্পন্সর খলিলুর রহমানকে নতুন চেয়ারম্যান করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকটির প্রাক্তন এক পর্ষদ সদস্য জানিয়েছেন, একীভূতকরণের প্রস্তাব নিয়ে পারভীন হক সিকদার নোট অব ডিসেন্ট জারি করেছিলেন।

এদিকে, নতুন চার পরিচালকের মধ্যে প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজুল করিম এফসিএমএকে মনোনয়ন দিয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক কে ওয়াই স্টিল। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিমকে মনোনয়ন দিয়েছে চট্টগ্রামের সুন্দরবন কনসোর্টিয়াম লিমিটেড। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম তোফাজ্জল হককে মনোনয়ন দিয়েছে চট্টগ্রামের ইস্ট কোস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের ভাই এরশাদ মাহমুদকে মনোনয়ন দিয়েছে চট্টগ্রামের স্টিচেস অ্যান্ড উইভ লিমিটেড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিন নিজামী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট রত্না দত্ত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবিএম জহুরুল হুদা।

রত্না দত্তের স্বামী সুব্রত কুমার ভৌমিক চট্টগ্রামভিত্তিক একটি বৃহৎ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক। হোসাফ গ্রুপ অব কোম্পানিজের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেনকে বোর্ডে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে সিকদার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি মনোনীত শফিকুর রহমানকেও বোর্ডে রাখা হয়েছে। নতুন বোর্ডে তিনিই একমাত্র পরিচালক যার সঙ্গে সিকদার গ্রুপের যোগসূত্র আছে।

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৯:১২ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।